হে ও সাইলেজ তৈরিকরণ

হে তৈরিকরণ-

হে (Hay) তৈরি উদ্দেশ্যঃ-

তাজা ও সবুজ ঘাস রোদে বা কৃত্রিম উপায়ে শুকিয়ে জলীয় অংশ এমন একটি মাত্রায় নিয়ে আসা হয় (১০-১৫%) যা ঐ ঘাসের

পুষ্টিমানসহ সংরক্ষণ করার উপযোগী হয়। ‘হে’ তৈরি করার জন্য নিম্নলিখিত বিষয়গুলো বিবেচনায় আনতে হবে।

যেসব ঘাসের কান্ড নরম, সহজে শুকানো যায় ও শুকানোর পর সহজে পাতা ঝরে পড়ে না সেসব ঘাস ‘হে’ করার জন্য নির্বাচন করতে হবে। উদাহরণসরূপ বলা যায় ওট, খেসারি, মাসকালাই ইত্যাদি ঘাস থেকে ভালো ‘হে’ তৈরি হয়।ঘাসের সঠিক পরিপক্কতা নির্ধারণ করতে হবে। ঘাস বেশি পাকা হলে ‘হে’ ভালো হয় না। সাধারণত নরম ফলসহ ‘হে’ করলে ভালো ফল পাওয়া যায়।

শুকানোর পদ্ধতি নির্বাচন- নিম্নোক্ত বিষয়গুলো বিবেচনা করে কাঁচা ঘাস শুকানোর পদ্ধতি নির্বাচন করা হয়। যেমন-

• কী পরিমাণ ঘাস কোন সময়ে পাওয়া যাচ্ছে

• বাতাসের আর্দ্রতা

• বৃষ্টিপাতের সম্ভবনা বা পরিমাণ এবং

• দিনের তাপমাত্রা ইত্যাদি।

আমাদের দেশে নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত বাতাসের আর্দ্রতা কম থাকে, বৃষ্টিপাত খুবই কম হয় এবং বিভিন্ন অঞ্চলে ডালজাতীয় অনেক ঘাস উৎপাদিত হয়। তখন এসব ঘাস সহজেই রোদে শুকিয়ে ‘হে’ তৈরি করা যায়। অন্যদিকে মে থেকে অক্টোবর পর্যন্ত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ও বাতাসে আর্দ্রতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ফলে সবুজ ঘাসের প্রাপ্যতাও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু রোদে শুকানো দুঃসাধ্য হয়ে উঠে। এ সময় কৃত্রিমভাবে ঘাস শুকানো যেতে পারে। খামারিদের কাছে সাধারণত যে পরিমাণ ঘাস পাওয়া যায় তা কৃত্রিম উপায়ে শুকানো ব্যয়বহুল।

ভালো হে-এর গুণাগুণ-

  • অ্যাসোমা গন্ধযুক্ত হবে।
  • নির্দিষ্ট জাতের ঘাস ব্যতীত অন্য কোনো অপ্রয়োজনীয় ঘাস বা আবর্জনা থাকবে না।
  • মোটামুটিভাবে দেখতে সবুজ মনে হবে।
  • ঘাসের পাতা এবং কান্ডের গঠন অটুট থাকবে।
  • গবাদিপশু সহজেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করবে।

খারাপ গুণাগুণ সম্পন্ন ‘হে’-

ঘাসের আর্দ্রতা ১৫-২০%-এর বেশি থাকলে ভালো ‘হে’ তৈরি করা সম্ভব হয় না।

এই ধরনের ‘হে’-এর অনেক বড় পুঞ্জের ভিতর হতে আগুন লাগতে পারে।

বেশি মাত্রায় অর্দ্রতা থাকলে ছত্রাক (ফাঙ্গাস) বা মোল্ড জন্মায়।

ঘাস সংগ্রহ ও ‘হে’ তৈরি সঠিক না হলে পাতা ঝরে যেতে পারে।

বৃষ্টির পানি পড়ে ভিজে যেতে পারে এবং অতিরিক্ত শুকানোর ফলে পুড়ে যেয়ে অনেক খাদ্য উপাদান নষ্ট হতে পারে।

‘হে’ সংরক্ষণ পদ্ধতিঃ-

হে তৈরির পর কোনো শেডের নিচে যেভাবে সংরক্ষণ করা যায় তা নিম্নরূপ-

  •  স্তুপ করে।
  •  বেল বা বোঝা বানিয়ে।
  •  কেটে ও স্তুপ করে।
  • পিলেট করে ব্যাগে সংরক্ষণ করা যায়।
  • কেটে চৌকোনা ব্লক করে সংরক্ষণ করা যায়।

এছাড়া বেল বা চৌকোনা ব্লক পলিথিন দিয়ে মুড়ে বাইরে পাকা মেঝেতে রাখা যেতে পারে।

‘হে’ প্রিজারভেটিভ ব্যবহারঃ-

ভালো ‘হে’ তৈরির জন্য ঘাসে সাধারণত ১০-১৫% জলীয় অংশ থাকা প্রয়োজন। ঘাসে জলীয় অংশের পরিমাণ ১৫% বা তারও বেশি রেখে সংরক্ষণ করার জন্য ‘হে প্রিজারভেটিভ’ হিসেবে সোডিয়াম অ্যাসিটেট, প্রপিওনিক অ্যাসিড, অ্যাসিটিক অ্যাসিড বা অ্যামোনিয়া গ্যাস ব্যবহার করা যায়। জলীয় অংশ বেশি থাকার ফলে ঘাসের পাতা ভেঙ্গে নষ্ট হয় না, সহজে বেল করা যায় এবং ফাঙ্গাস বা মোল্ড ধরে না।

হে তৈরির সময় পুষ্টিমানের অপচয়:-

হে তৈরির সময় সাবধানতা অবলম্বন না করলে হে এর পুষ্টি মানের অপচয় হবে। নিম্নে সংক্ষেপে এগুলো বর্ণনা করা হলো-

১। অতিরিক্ত শুকিয়ে ফেললে: হে তৈরিতে ঘাস অতিরিক্ত শুকালে এর পাতা সহজে ঝরে পড়ে ফলে পুষ্টিমানের অপচয় হতে পারে।

২। সঠিক সংরক্ষণ: হে তৈরি করে ভালভাবে সংরক্ষণ না করলে বৃষ্টির পানি লিকেজ হয়ে এর পুষ্টি উপাদানের অপচয় হতে পারে।

৩। পরিপক্কতা: হৈ তৈরির ব্যবহৃত ঘাস বেশি পরিপক্ক হলে এতে পুষ্টি উপাদান কম পাওয়া যাবে। সাধারণত নরম ফলসহ হে করলে

বেশি পুষ্টিমান পাওয়া যায়। ৪। তাজা ও সবুজ ঘাসের ধরন: হে তৈরির ঘাস নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ঘাসের পুষ্টিমান বেশি হলে হে এর পুষ্টিমান বেশি পাওয়া সম্ভব।

হে ও সাইলেজ তৈরিকরণ

হে ও সাইলেজ তৈরিকরণ

হাইড্রোফোনিক ঘাসঃ-

পুষ্টিগত বৈশিষ্ট্যঃ-

হাইড্রোফোনিক ঘাস খুবই পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাদ্য। এতে পর্যাপ্ত প্রোটিন, শক্তি এবং ভিটামিন বিশেষ করে ই-ক্যারোটিন, ট্রেস মিনারেল, হরমোন এবং এনজাইম থাকে যা প্রাণির দেহের স্বাভাবিক বৃদ্ধির জন্য খুবই প্রয়োজনীয়।

বীজ- হাইড্রোফোনিক ফডার উৎপাদনের জন্য সবচেয়ে ভাল বীজ হচ্ছে বার্লি। তবে অন্যান্য দানাদার বীজ যেমন: গম ও সরগম পছন্দনীয়।

জায়গা- হাইড্রোফোনিক ঘাস উৎপাদনে অনেক কম জায়গার প্রয়োজন হয়। অনেক দেশেই এটি এখন গবাদিপশুর একটি উত্তম খাদ্য হিসাবে ব্যবহৃত হয়।

সুবিধা-

১। এই ঘাস উৎপাদন পদ্ধতিতে খরচ অনেক কম।

২। অল্প জায়গাতেই এই ঘাস উৎপাদন করা যায়।

৩। বছরের যে কোনো সময় উৎপাদন করা যায়।

৪। যখন গো খাদ্যের স্বল্পতা তখন এই ঘাস খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে।

৫। হে এবং অনেক বাণিজ্যিক খাদ্যের চেয়ে ভাল খাদ্য এই হাইড্রোফোনিক ঘাস।

৬। এই ঘাসের পুষ্টি শুধুমাত্র মূল ও পাতার উভয় থেকে এসে থাকে।

৭। হাইড্রোফোনিক ঘাস যে কোন ধরনের পেস্টিসাইড, হার্বিসাইড বা সার প্রয়োগ ছাড়াই উৎপন্ন করা যায়

৮। এই ঘাস জন্মাতে কোন মাটির প্রয়োজন হয় না।

৯। গবাদিপশু সম্পূর্ণ ঘাসই খেতে পারে।

১০। এই ঘাস প্রাকৃতিক ঘাসের অনুরূপ যা প্রাণির উন্নত পুষ্টি ও ফার্মেনটেশনে সাহায্য করে।

 

হাইড্রোফোনিক ও ফডারের মিশ্র চাষঃ-

হাইড্রোফোনিক ফডার হচ্ছে এক ধরনের নরম, কচি ঘাস যা তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা নিয়ন্ত্রণ করে একটি কক্ষে উৎপাদন করা হয়। সাধারণত দানাদার শষ্য গম, বালির বীজ ব্যবহার করে এই ঘাস ট্রে এর মধ্যে উৎপাদন করা হয়। বিশ্বে অনেক ঘাসের চেয়ে হাইড্রোনিক ঘাসের মূল খুব ছোট যাতে একটি নির্দিষ্ট জায়গায় অনেক বেশি ঘাস জন্মানো সম্ভব।এতে ক্রপ Rotation এর প্রয়োজন হয় না। এই পদ্ধতিতে প্রতিদিন ৬০০-১০০০ কেজি ভুট্টা ৭-৮ দিনের Groth Cycle এ জন্মানো সম্ভব। এতে জায়গার পরিমাণ ৪৫-৫০ মি ২ প্রয়োজন হবে।

সাইলেজ তৈরিকরণ-

সাইলোতে সংরক্ষিত ঘাসকে সাইলেজ বলা হয়ে থাকে।আবার, সাইলেজ তৈরির উক্ত প্রক্রিয়াকে অ্যানসাইলেজিং বলে। সাধারণত তাজা ও সবুজ ঘাস সংরক্ষণের জন্য এ পদ্ধতিটি ব্যবহৃত হয়। সাইলেজ তৈরির জন্য একটি বায়ুনিরোধক বা মোটামুটিভাবে বায়ু চলাচল করতে পারে না এমন ধরনের ধারককে সাইলো বলে।

সাইলোর প্রকারভেদ-

• ট্রেন্স সাইলো

• বাংকার সাইলো

• টাওয়ার সাইলো

ট্রেন্স সাইলো-

উঁচু জায়গা বা পাহাড়ের ঢালে মাটি খুঁড়ে ট্রেন্স সাইলো তৈরি করা হয়। এ ধরনের সাইলো মাটির গর্তের তলা থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিক প্রশস্ত হয়। গর্তের দৈর্ঘ্য ঘাসের পরিমাণের উপর নির্ভর করে। গর্তের তলা বা পার্শ্বগুলো খড়কুটো দিয় ঢেকে বা পাকা করেও সাইলেজ তৈরিতে ব্যবহার করা যায়।

বাংকার সাইলো- এই ধরনের সাইলো মাটির উপরে কাঠের বা পাষ্টিকের দেয়াল তৈরি করে করা হয়। ট্রেন্স সাইলো মাটির নিচে গর্ত করে আর বাংকার সাইলো মাটির উপরে তৈরি করা হয়। দু’ধরনের সাইলোর মধ্যে এটিই মূল পার্থক্য।

 

টাওয়ার সাইলো- টাওয়ার সাইলো আয়াতকার করে মাটির উপরে তৈরি করা হয়। এটি বেশ ব্যয়বহুল।

 

কী ধরনের ঘাস সাইলেজ করা যায়?

যেসব ঘাসের মধ্যে পরিমাণমতো জলীয় অংশ (৬০-৭০%), সহজপাচ্য শর্করা ও অন্যান্য খাদ্যোপাদান থাকে ও সহজে গাঁজানো (Packing) যায় তা সাইলেজ করার জন্য ব্যবহার করা যায়। ডালজাতীয় ঘাস, যেমন- কাউপি, খেসারি সাধারণত ‘হে’ তৈরি করে সংরক্ষণ করা হয়। এ ধরনের ডাল ও অ-ডালজাতীয় ঘাস, যেমন- ভূট্টা, সরগাম বা খড়ের সঙ্গে স্তরে স্তরে সাজিয়ে সাইলেজ তৈরি করা যায়। সংরক্ষণের জন্য চিটাগুড় ঘাসের ওজনের ২-৩% ব্যবহার করতে হবে।

কীভাবে সাইলেজ তৈরি হয়?

তাজা ও সবুজ ঘাস সুন্দর করে গাঁদানো হয় যাতে ঘাসের ফাঁকে কোনো বাতাস না থাকে। যতটুকু বাতাস থাকে তার অঙ্কিজেন ব্যবহার করে ঘাসের শর্করা থেকে পানি, কার্বন ডাই-অগ্রইড ও প্রচুর তাপ উৎপন্ন হয়। এই তাপে যে পরিবেশ সৃষ্টি হয় তা ব্যবহার করে ব্যাকটেরিয়া দিয়ে বিভিন্ন প্রকার শর্করা ভেঙ্গে ল্যাকটিক অ্যাসিড উৎপন্ন হয়। উৎপাদিত ল্যাকটিক অ্যাসিড ঘাসের Ph হ্রাস করে ঘাসের পচন বন্ধ করে ও ঘাস সংরক্ষিত হয়। সাইলোর ভিতর কোন প্রকারে বাতাস প্রবেশ করলে পুনরায় পচন শুরু হয়।

টাওয়ার সাইলোঃ-

সাইলেজ অ্যাডিটিভ-

সাইলেজে গাঁজন প্রক্রিয়া দমন বা তরান্বিত করার জন্য অ্যাডিটিভ ব্যবহার করা হয়। ফরমিক বা প্রপিওনিক অ্যাসিড যোগ করে গাঁজন প্রক্রিয়া দমন করে ঘাস সংরক্ষণ করা হয়। অন্যদিকে চিটাগুড়, শস্য ভাঙ্গা ইত্যাদি ব্যবহার করে গাঁজন প্রক্রিয়া তরান্বিত করা যায় ও পরিমিত পরিবেশে ঘাস সংরক্ষণ করা যায়।

সাইলেজ পুষ্টিমানের প্রভাব সৃষ্টিকারী বৈশিষ্ট্য-

সাইলেজের পুষ্টিমান কিছু বৈশিষ্ট্যের উপর নির্ভর করে নিয়ে এগুলো উল্লেখ করা হলো।

১। ঘাসের পরিপক্কতা- ঘাস বেশি পরিপক্ক হলে এতে পুষ্টি উপাদানের পরিমাণ কমে যায়। কাজেই অপেক্ষাকৃত কম পরিপক্ক ঘাস দ্বারা তৈরি সাইলেজ পুষ্টিমান বেশি পাওয়া যায়।

২। ঘাসের প্রকৃতি- কোন ধরনের ঘাস/ফডার দ্বারা সাইলেজ তৈরি করা হচ্ছে তার উপর সাইলেজের পুষ্টিমান নির্ভর করে। সাধারণত লিগুমিনাস ফডার ব্যবহারে সাইলেজের আমিষের পরিমাণ বেড়ে যায়।

৩। সাইলেজের ধরন- সাইলোর ধরনের উপরও সাইলেজের পুষ্টিমান নির্ভর করে। কাজেই ঘাসের ফার্মেন্টেমন যাতে ভালো হয় এমন সাইলো ব্যবহার করতে হবে।

৪। ফিড অ্যাডিটিভসের পরিমাণ- সাইলেজ তৈরির সময় কোন ধরনের প্রিজারভেটিভস বা ফিড অ্যাডিটিভস ব্যবহার করা হচ্ছে তার উপরও সাইলেজের পুষ্টিমান কম বেশি হতে পারে।

৫। সময়- সাইলেজ তৈরির নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পুষ্টি উপাদানের পার্থক্য হতে পারে। যদি নির্দিষ্ট সময়ের আগেই ফার্মেন্টেশন প্রক্রিয়া বন্ধ করে দেয়া হয় সেক্ষেত্রেও পুষ্টি উপাদানের পার্থক্য হতে পারে।

বাংলাদেশে ফডার উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা