বাংলাদেশে ফডার উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা

বাংলাদেশে ফডার উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনাঃ-

সাধারণত ফডার গৃহপালিত পশুদের খাওয়ানোর জন্যই উৎপাদন করা হয়। বড় আকারের গৃহপালিত পশুর খামারের খাবারের নাহিদা মেটানোর জন্য ফডার ঘাস উৎপাদন করা হয় যা সারা বছর গবাদিপশুকে খাবার সরবরাহ করা যায়।বাংলাদেশে সাধারণত খড় এবং তৈলবীজ উদ্ভিদের উচ্ছিষ্টাংশ দিয়েই বেশিরভাগ গবাদিপশুর খাদ্যের চাহিদা পূরণ করা হয়। বিভিন্ন রনের ফডার ঘাস উৎপাদনের জন্য কিছু সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলোঃ-

১। বাংলাদেশে জমি অপ্রতুলতা ফডার উৎপাদনের জন্য প্রধান সমস্যা। যেখানে মানুষের খাদ্য শস্য উৎপাদনের জমিরই স্বল্পতা রয়েছে যেখানে গবাদিপশুর জন্য বড় আয়তনের জমি পাওয়া সত্যিই কষ্টসাধ্য ব্যাপার।

২। কৃষকদের ফডার উৎপাদন সম্পর্কে যেসব জ্ঞান থাকা উচিত তা একবারে স্বল্প। তারা ফডার উৎপাদন সম্পর্কে সঠিক ধারনা না রাখার জন্য কোন মৌসুমে কোন ঘাস আবাদ করা হয়, কীভাবে জমি তৈরি করতে হবে এই বিষয়গুলো তারা সঠিকভাবে বুঝতে পারে না। তাই ফডার উৎপাদনের সমস্যা হয়ে দাড়ায়।

৩। ফডার উৎপাদনের জন্য আরেকটি বড় সমস্যা হল তথ্যের অভাব। সঠিক তথ্যের অভাবে খামারীদের বড় ধরনের বিপদের মুখোমুখি হতে হয়। ফডার উৎপাদনের জন্য সরকারিভাবে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের খামারীদের তথ্য সরবরাহ করা হলে উৎপাদন বহুলাংশে বৃদ্ধি পাবে।

৪। বাংলাদেশের কিছু জায়গার দেখা যায় দেশের নিজস্ব জাতের ঘাসের ফলন হয়। কিন্তু এর উৎপাদন ক্ষমতা খুবই কম। আবার দেশের বাহির থেকে ঘাসের বীজ নিয়ে এসে রোপন করলেও এর উৎপাদন ক্ষমতা পূর্বের মতো বেশি হয় না। ফলে কোন মাটিতে কোন ঘাস লাগালে সর্বোচ্চ উৎপাদন পাওয়া যাবে সে বিষয়ে সচেতন থাকতে হবে।

৫। ভাল মানের বীজের অভাব এবং অপর্যাপ্ত বীজ সরবরাহ ফডার উৎপাদনের ক্ষেত্রে একটি অন্যতম সমস্যা। মাঝে মাঝে দেখা যায় ভাল বীজের দামও অনেক বেশী হয়। যার কারণে চাষীরা অনুৎসাহিত হয় এবং ফডার উৎপাদন কমে যায়।

৬। কিছু মানুষের কৃতকর্ম যেমন, খামারের সম্প্রসারণ, শিল্পায়ন, জমি ভরাট, নদী ভাঙ্গন এসবও ফডার উৎপাদনের পথে বাধা হয়ে দাড়ায়।

৭। দেশে পর্যাপ্ত পুষ্টি বিজ্ঞানীর অভাব যারা প্রয়োজনীয় গবেষণা করে ফডার চাষের উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করবে। মোটকথা, বলা যায় বাংলাদেশে উপরোক্ত সমস্যাগুলো লাঘব করা গেলে ফডার উৎপাদনের জন্য অনুকুল পরিবেশ সৃষ্টি হবে। আর বেশি ফডার উৎপাদন হলে গবাদিপশুর উৎপাদনও বাড়বে এব দেশে প্রাণিজ আমিষের ঘাটতি কমতে থাকবে।

৮। আধুনিক প্রযুক্তি যেগুলো ফডার উৎপাদনের সহায়ক তা কৃষকের নিকট সহজে পৌছে না।

৯। পর্যাপ্ত উপকরণে যেমন- সার, সেচ ও ভর্তুকির অভাব।

১০। ফডারের উপকারিতা কৃষকদের সরাসরি প্রদর্শনের সরকারি ব্যবস্থার অভাব।

বাংলাদেশে ফডার উৎপাদনের সমস্যা ও সম্ভাবনা

ফডার উৎপাদনের সম্ভাবনাঃ-

ফভার গবাদিপশু পালনে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। আমাদের দেশের গবাদিপশু পালনে প্রধান সমস্যা খাদ্য। কাজেই পর্যাপ্ত ফড়ার উৎপাদন করে এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। নিম্নে ফডার উৎপাদনের সম্ভাবনা তুলে ধরা হলো।

১। বাংলাদেশের মাত্র ০.০৩% ভূমি ফভার উৎপাদনের জন্য ব্যবহৃত হয়। তবে মানুষ ধানী জমিতে ফডার না লাগালেও খাল, নদী নালার তীর, রাস্তার দুপাশে ও রেললাইনের ধারে ফডার উৎপাদনের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ছাড়া ধান কাটার পর স্বল্প সময়ের ফভার উৎপাদন করা সম্ভব।

২। দেশে এখন অনেক কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে উঠেছে পশুপুষ্টি বিষয়ে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীর সংখ্যা এখন কম নয়। এসব প্রতিষ্ঠান থেকে পাশ করা পুষ্টিবিদ কৃষকদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে ফডার উৎপাদনে উদ্বুদ্ধ করতে পারবে।

৩। বাংলাদেশে এখন ডিজিটাল যুগে প্রদার্পন করেছে। কাজেই তথ্যের অভাব নেই। বর্তমানে টেলিভিশন, রেডিও, পত্রিকার মাধ্যমে ফডার উৎপাদনের বিভিন্ন তথ্য দ্রুত পাওয়া সম্ভব।

৪। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাভার এ ফডারের জামপ্লাজম রয়েছে। যে কেউ এখান থেকে ফডােেরর কাটিং নিয়ে অনায়াসে ফডার উৎপাদন করতে পারে।

৫। সরকারের বিভিন্ন পলিসিতেও ফডার উৎপাদনের উপর বেশ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

৬। এ দেশের মাটি ও আবহাওয়া ফডার উৎপাদনের জন্য অনুকূল।

৭। লবণাক্ত এলাকার জন্য বিশেষ ফডার উৎপাদনের সুযোগ রয়েছে।

৮। হাইড্রোফোনিক ঘাস উৎপাদনের কৌশল এখন বাংলাদেশে ব্যবহৃত হচ্ছে।কাজেই এ পদ্ধতি ব্যবহার করে অধিক উৎপাদন সম্ভব।

লিন সিজনে খাদ্য ব্যবস্থাপনাঃ-

লিন সিজন বলতে যে সময় গবাদিপশুর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য পাওয়া যায় না সে সময়কে বুঝায়। এ সময়টি পশুপালনে বিশেষ সমসার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে বর্ষার সময় পশু খাদ্যের প্রকট সমস্যা দেখা যায়। রাফেজ জাতীয় খাদ্যের মধ্যে খড় গবাদিপশু বিশেষ করে গরু/ভেড়া/ পালনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। এই খড় মোট আঁশজাতীয় খাদ্যের প্রায় ৮০%। খড় মূলত ধান ও গমের উপজাত, কাজেই সারা বৎসর খড় পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। সবুজ ঘাস যেমন রোড সাইড ও শষ্য ক্ষেতের আগাছা সংগ্রহ করে গবাদিপশুকে সরবরাহ করা নির্ভর করে কৃষক এগুলো সংগ্রহে কী পরিমাণ সময় দিয়ে থাকে। কাজেই গবাদিপশুকে তার চাহিদামত পর্যাপ্ত খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব হয় না। আবার বর্ষার সময় সবুজ ঘাস কৃষকেরা না পাওয়ায় গরু পালনে বিশেষ সমস্যার সম্মুখীন হয়। এসব কারণে লিন সিজনে অর্থাৎ যখন পর্যাপ্ত খাবার পাওয়া যায় না সেক্ষেত্রে খাদ্য ব্যবস্থাপনা কীভাবে করতে হবে নিম্নে লেখা হলো।

১। খড় সংগ্রহ রাখাঃ

যখন খড়ের মৌসুম থাকে অর্থাৎ বেশি পরিমাণ খড় পাওয়া যায় তখন অনেক খড় ক্রয় করে সংগ্রহ করতে হবে যা সারা বছর ব্যাপি পশুকে সরবরাহ করা যায়। খড়ের পুষ্টিমান কম তাই ইউরিয়া বা অন্য কোন রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করে খড় প্রক্রিয়াজাত করে খাওয়ানো যেতে পারে। এতে করে খড়ের পুষ্টিমান বেড়ে যাবে। গবাদিপশুর উৎপাদনও বেড়ে যাবে।

২। ফডারঃ

ফড়ার চাষ করা ও বর্তমানে উচ্চফলনশীল ঘাসের কাটিং বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর ও অন্যান্য সরকারী খামারে পাওয়া যায়। এসব কাটিং সংগ্রহ করে ফডার চাষের ব্যবস্থা করতে হবে। জার্মান, প্যারা, নেপিয়ার ও অন্যান্য ফডার চাষ করে সবুজ ঘাসের চাহিদা পূরণ করা সম্ভব। এসব ঘাস গাভীর দুধের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং প্রাণিদের সুস্থ্য রাখে। ফডার রবি ও খরিপ উভয় মৌসুমে লাগানো যায়। এদের ফলন ভালো এবং সারা বছর ধরে প্রাণিকে খাওয়ানো যায়।

৩। হে তৈরি করে রাখাঃ

বর্ষা মৌসুমে জলীয় অংশের পরিমাণ বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন অঞ্চলে প্রাকৃতিকভাবে অথবা চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় যে ঘাস উৎপাদন হয় তাৎক্ষণিকভাবে তা ব্যবহার করা সম্ভব হয় না। অতিরিক্ত এ ঘাস হে করে সংরক্ষণ করা যেতে পারে। প্রকৃতভাবে তাজা ও সবুজ ঘাস রোদে অথবা কৃত্রিম উপায়ে শুষ্ক করে জলীয় অংশের পরিমাণ ১০-১৫% এ নিয়ে এসে উক্ত ঘাসের পুষ্টিমান সহ সংরক্ষণ করাকে হে বলে। হে তৈরির জন্য ঘাসের কান্ড নরম ও সহজে শুকানো যায় এবং শুকানোর পর সহজে পাতা ঝরে না এমন ঘাস উপযোগী, যেমন-ওট, খেসারী, মাসকলাই ইত্যাদি ঘাসের হে ভালো হয়।

৪। সাইলেজ তৈরিঃ

বিভিন্ন দেশে সাইলেজ তৈরি করে ঘাসকে সংরক্ষণ করে লিন সিজনে ব্যবহার করা হয়। আমাদের দেশে সাইলেজ তৈরি করে ঘাস সংরক্ষণের প্রচলন কম। সাধারণত বায়ু নিরোধক স্থানে (সাইলো) সংরক্ষিত ঘাসকে সাইলেজ বলে। সাইলেজ তৈরির এ প্রক্রিয়াকে এনসাইলজিং বলা হয়।যে সমস্ত ঘাসের মধ্যে জলীয় অংশ ৬০-৭০%। সহজপাচ্য শর্করা এবং অন্যান্য পুষ্টি উপাদান আছে এবং সহজে গজানো যায় তা সাইলেজ করার জন্য ব্যবহার করা যায়। যে স্থানে সাইলেজ করা হয় তাকে সাইলো বলে। সাইলে বিভিন্ন প্রকার হতে পারে। যেমন-ট্রেন্স সাইলো, বাংকার সাইলো, টাওয়ার সাইলো ইত্যাদি।

৫। শষ্য দানার উপজাত সংগ্রহ করাঃ

বিভিন্ন প্রকার শস্যদানার উপজাত যেমন গমের ভূষি, রাইব্রান, খৈল (সরিষা/তিল) এগুলো সবসময় বাজারে পাওয়া যায় না। কাজেই এ জাতীয় শষ্য উপজাত সংগ্রহ করার ব্যবস্থা করতে পারলে লিন সিজনেও গবাদিপশুকে সরবরাহ করা যেতে পারে।

৬। রাস্তার দু’পাশে গাছ লাগিয়ে, রেললাইনের ধার বা নদীর দুইধারে ফডার উৎপাদন করেও লিন সিজান খাদ্যের ব্যবস্থা করা যায়।

গবাদিপশুর খাদ্য তৈরিকরণের গুরুত্ব