গবাদিপশুর খাদ্য তৈরিকরণের গুরুত্ব

গবাদিপশুর খাদ্য তৈরিকরণের গুরুত্ব-

গবাদিপশুর জীবনধারনের জন্য খাদ্য অতীব প্রয়োজনীয়। যেসব উপকরণ বা বস্তু খেলে পশুর ক্ষুধা নিবারণ ও দেহে শক্তির সঞ্চার হয় তাকেই আমরা খাদ্য বলি। পশুপাখি প্রকৃতির বাসিন্দা হয়ে যতদিন চড়ে খেয়েছে ততদিন তার প্রয়োজনীয় খাদ্য সে নিজেই সংগ্রহ করেছে তখন থেকেই তার খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়গুলো মানুষের ভাবনায় এসেছে। এরপর প্রাণিদের যখন বিকল্প সম্পদ হিসেবে বিবেচনায় আনা হয়েছে তখন উপকরণগুলো শুধু তৈরি নয় কত সহজে ও স্বল্প ব্যয়ে উপকরণ বা কাঁচামাল তৈরি করা যায় তা বিবেচনা করা হয়েছে। গবাদিপশুর শিল্পের প্রয়োজনীয় কাঁচামালের শতকরা ৬৫-৭০ ভাগ খরচ হয় খাদ্যের জন্য। তাই এই খাদ্য সঠিক পন্থায় তৈরি করা না হলে এ শিল্প থেকে মুনাফা লাভ অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ে। নির্দিষ্ট প্রকার পশুর জন্য আলাদা আলাদাভাবে খাদ্য তৈরি করতে হবে কেননা তাদের আকার ও প্রকারভিত্তিক প্রয়োজনও বিভিন্ন রকমের হয়। পশুর প্রয়োজন অনুযায়ী উপযুক্ত খাদ্য তৈরি করতে হবে যাতে পরিমানমত শুষ্ক পদার্থ, আমিষ ও ভিটামিন সরবরাহ করা যায়।আর তা ঠিকমতো সরবরাহ করা না হলে পশুর বৃদ্ধি ব্যহত হবে এবং পশুর দুধ মাংস উৎপাদনও কমে যাবে। এর সাথে সাথে প্রাণী বিভিন্ন ধরনের রোগে আক্রান্ত হতে পারে যা আমাদের প্রাণীশিল্পের হতে মুনাফা অর্জনের পথে বাধা হতে পারে। খাদ্য তৈরীকরনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো খাদ্য খরচ নির্ণয়। আমাদের খাদ্য তৈরীকরনের উদ্দেশ্য থাকবে সবচেয়ে কম খরচে প্রাণির জন্য প্রয়োজনীয় সবচেয়ে বেশি পরিমাণ পুষ্টিমান সমৃদ্ধ খাদ্য সরবরাহ করা আর তাই গবাদিপশু পালনে বা এই শিল্পের জন্য খাদ্য তৈরীকরনের ভূমিকা অপরিসীম।নিম্নে খাদ্য তৈরিকরণেরর গুরুত্ব বিষদভাবে আলোচনা করা হলোঃ-

১। সঠিক পরিমাণে খাদ্য সরবরাহ: গবাদিপশুর দৈহিক ওজন ও আকারের উপর ভিত্তি করে খাদ্য সরবরাহের পরিমাণ হ্রাসবৃদ্ধি ঘটে। এছাড়া গবাদিপশু তার উৎপাদনের কোন স্তরে আছে তার উপরও খাদ্যের পরিমাণ নির্ণয় করে। কাজেই এসব বিষয় বিবেচনা করে খাদ্য তৈরি করে পশুদের সরবরাহ করতে হবে। আর এ জন্য খাদ্য তৈরির গুরুত্ব অপরিসীম।

২। সঠিক পরিমাণে পুষ্টি উপাদান সরবরাহ: বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান যেমন আমিষ, শর্করা, ইত্যাদি গাভী দুধ দেয়ার আগে ও পরে সরবরাহের ভিন্নতা থাকে। কাজেই সঠিকভাবে খাদ্য তৈরি করে প্রাণিকে সরবরাহ করলে গাভির দুধ উৎপাদন বেড়ে যাবে এবং প্রাণি সুস্থ থাকবে।

৩। খাদ্যের অপচয় রোধ: পশুর উৎপাদনের স্তর, বয়স ও লিঙ্গভেদ বিবেচনা করে খাদ্য তৈরি করলে অহেতুক বেশি খাদ্য তৈরি করতে হবে না। এভাবে খাদ্যের অপচয় রোধ করা সম্ভব। এছাড়া খাদ্য তৈরি করে ওজন করে সরবরাহ করলেও খাদ্যের অপচয় কম হবে।

৪। সব পুষ্টি উপাদান সমন্বয়: খাদ্যের বিভিন্ন প্রকারের উপাদান বেশি মাত্রায় অন্তর্ভূক্ত করে সব ধরনের পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় সাধন করা সম্ভব। এক্ষেত্রে বিভিন্ন খাদ্য উপকরণের রাসায়নিক বিশ্লেষণের প্রয়োজন হবে। সব পুষ্টি উপাদানের সমন্বয় ঘটাতে পারলে পশুর সুষম খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব।

৫। অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি: সঠিক খাদ্য তৈরির মাধ্যমে একটি খামারের প্রাণিদের সঠিক অনুপাতে খাদ্য সরবরাহ করা সম্ভব। এতে খামারের উৎপাদন ক্ষমতা বেড়ে যাবে এবং বেশি পরিমাণ দুধ ও মাংস পাওয়া সম্ভব। এতে করে খামার মালিক ও দেশ উভয়ই অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধশালী হবে।

৬। শ্রমিক খরচ: সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে খাদ্য তৈরিকরণে অতিরিক্ত শ্রমিকের প্রয়োজন হবে না, কেননা পূর্ব হতে পরিকল্পনা অনুযায়ী খামারে বিদ্যমান পশুর বয়স, উপাদানের স্তর এর উপর ভিত্তি করে খাদ্য তৈরি করা হবে।

৭। সময়ের অপচয় রোধ: খাদ্য তৈরিকরণে এখন বিভিন্ন প্রকার সফটওয়্যার পাওয়া যায়। এগুলো ব্যবহার করে একটি খামারের প্রাণির ধরন অনুযায়ী খুব কম সময়ে খাদ্য তৈরি করা সম্ভব। এক্ষেত্রে সময় ও শ্রমিক খরচ অনেক কমে যাবে।

৮। চিকিৎসা খরচ কমে আসবে: সঠিক উপায়ে খাদ্য তৈরি করতে পারলে পশুরা পর্যাপ্ত পুষ্টি পাবে ও সুস্থ্য থাকবে। এতে করে পশুর রোগ ব্যাধি কম হবে এবং চিকিৎসার জন্য অতিরিক্ত খরচ বহন করতে হবে না।

গবাদিপশুর  খাদ্য তৈরিকরণের গুরুত্ব

সুষম খাদ্যের গুরত্বঃ-

১. পশুকে সুষম খাদ্য খাওয়ালে পশু সুস্থ ও সবল হয়।

◊ পশুর স্বাস্থ্য ভাল থাকে।

◊ পশুর কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

◊ পশুর মাংস ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা বাড়ে।

◊ পশুর বৃদ্ধি স্বাভাবিক থাকে।

◊ খামারের সার্বিক লাভ হয়।

◊ পশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

◊ পশু হতে প্রাপ্ত দ্রব্যের (মাংস, দুধ, ও অন্যান্য উপজাত) গুণগত মান বৃদ্ধি পায়।

◊ গবাদিপশুর রোগব্যাধি কম হয়।

◊ কম সময়ে বড় আকারের সুস্থ ও সবল গরু পাওয়া যায়।

 

সুষম খাদ্যের বৈশিষ্ট্যঃ-

◊ সুষম খাদ্য সুস্বাদু হবে।

◊ সব ধরনের খাদ্য উপাদান সুষম অনুপাতে থাকবে।

সুষম খাদ্য তৈরির উপকরণ ও নিয়মাবলি- সবুজ কাঁচা ঘাস ও দানাদার খাদ্য সুষম খাদ্যের অন্তর্ভূক্ত। গবাদিপশুর সুষম খাদ্য উপকরণ এবং সুষম খাদ্য তৈরির নিয়মাবলি নিচে উল্লেখ করা হল।

 

খড়ঃ-

◊ খড় হল আঁশযুক্ত খাদ্য। একটি দেশী গরুকে দৈনিক ৩-৪ কেজি শুকনা খড় খাওয়াতে হবে।

◊ খড় ছোট ছোট করে কেটে বড় পাত্রের মধ্যে পানি বা ভাতের মাড়ে ভিজিয়ে তাতে প্রয়োজনীয় দানাদার খাদ্য ও ৩০০-৪০০ গ্রাম ঝোলাগুড় মিশিয়ে খাওয়ালে খড়ের পুষ্টিমান বৃদ্ধি পায়।

◊ তাছাড়া ইউরিয়ার সাথে খড় প্রক্রিয়াজাতকরণ করে খাওয়ানো যায়।

সবুজ কাঁচা ঘাসঃ-

◊ গবাদিপশুর প্রধান খাদ্য সবুজ কাঁচা ঘাস। সবুজ কাঁচা ঘাস আঁশযুক্ত খাদ্য।

◊ দেশীয় একটি গরুকে দৈনিক ১০-১২ কেজি এবং উন্নত জাতের একটি বড় গরুকে দৈনিক ১২-১৫ কেজি সবুজ কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হয়।

◊ গাভী পালন করে তার থেকে বেশি দুধ পেতে হলে তাকে অবশ্যই প্রচুর কাঁচা ঘাস খাওয়াতে হবে।

◊ উন্নত জাতের কাঁচা ঘাসের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল- নেপিয়ার, পারা, ভূট্টা, সরগম, জার্মান, গিনি, সিগনাল, ওটস/যব ইত্যাদি। এদের ফলন ও পুষ্টিমান বেশি থাকে।

◊ কাঁচা ঘাসের অভাব হলে পশুকে গাছের সবুজ পাতা বিভিন্ন রকমের লতাপাতা তরকারির খোসা ও ফলমূলের উচ্ছিষ্ট অংশ খাওয়ানো যায়।

◊ বিভিন্ন জাতের ডুমুর, ডেউয়া, মান্দার, ইপিল-ইপিল গাছের পাতা পশুকে খাওয়ানো যায়।

◊ এ ছাড়া এ সকল সবুজ কাঁচা ঘাস সমূহ দ্বারা সাইলেজ, হে ইত্যাদি তৈরি করেও গবাদিপশুকে খাওয়ানো যায়। সাধারণত অমৌসুমে অর্থাৎ যখন কাঁচা ঘাসের অভাব দেখা দেয় তখন সাইলেজ বা হে খাওয়ানো হয়।

 

ক্যাটেল ফডার সনাক্তকরণ-

 

১। সাধারণ নাম: পারা ঘাস, বৈজ্ঞানিক নাম: Brachiaria mutica।

ফডারের ধরন: বার্ষিক

বৈশিষ্ট্য: পাতাসহ পুরো শরীর লোমযুক্ত।

• ডাটা গঠনে গোল, ফাঁপা এবং শক্ত।

• পাতাগুলো খাটো এবং তীক্ষ্ণ

• মধ্য শিরা খুব বড় নয়।

• মূলে কোন নডিউলস নেই।

২. সাধারণ নাম: জার্মান ঘাস, বৈজ্ঞানিক নাম : Echinolora grousgali

ফডারের ধরন: বার্ষিক

বৈশিষ্ট্য: ডাটা শক্ত, গোল এবং সোজা।

• অপরিণত পাতার তলদেশে লোম থাকে।

• ডাটাতে ফাঁপা ম্যাট্রিক্স থাকে।

• তুলনামূলকভাবে দীর্ঘ কিন্তু সংকীর্ণ

• মধ্য শিরা বড় নয়।

৩. সাধারণ নাম: ন্যাপিয়ার ঘাস/হাতি ঘাস, বৈজ্ঞানিক নাম: Pennisetum purpureum

ফডারের ধরন: বার্ষিক।

বৈশিষ্ট্য: ডাটা চ্যান্টা এবং দৃঢ়।

• পাতার নিচের দিকে দীর্ঘ লোম থাকে।

• পাতাগুলো বড় এবং অমসৃণ।

• মূলে নডিউল থাকে না।

• ডাটা শক্ত এবং কাষ্ঠ-সদৃশ।

৪. সাধারণ নাম: ভূট্টা ফডার, বৈজ্ঞানিক নাম: Zea mays

ফডারের ধরণ: বার্ষিক।

বৈশিষ্ট্য: ডাটা চ্যাপ্টা এবং শক্ত।

• ডাটা পুরু এবং রং হালকা গোলাপী।

• পাতাগুলো তুলনামূলক বড় এবং বিস্তীর্ণ

• পাতাগুলো লোমযুক্ত।

• মূলে নডিউল নেই।

৫. সাধারণ নাম: দুর্বা ঘাস, বৈজ্ঞানিক নাম: Cynodon dactylon

ঘাসের ধরন: বার্ষিক।

বৈশিষ্ট্য: মূলে নডিউল অনুপস্থিত।

• ডাটা গঠনে গোল এবং শক্ত।

• পাতাগুলি খাটো এবং বড়।

• প্রত্যেকটা ইন্টিমোডস থেকে দুইটি করে পাতা বেরিয়ে আসে।

৬. সাধারণ নাম: ভুট্টা বীজ। বৈজ্ঞানিক নাম: Zea myas

ঘাসের ধরন: বার্ষিক

বৈশিষ্ট্য: রং হলুদাভ

• চ্যাপ্টা এবং প্রায় চতুষ্কোণ আকৃতির

• উপরের শীর্ষদেশে গর্ত রয়েছে।

• ছোট এবং সরু।

৭. সাধারণ নাম: ভুট্টা চূর্ণ, বৈজ্ঞানিক নাম: Zea myas

বৈশিষ্ট্য: ভুট্টা উপস্থিত থাকে।

• ভুট্টার রুচিকর সুগন্ধ থাকে।

• ভুট্টার ভূসি উপস্থিত।

• আকৃতি অসমতল।

৮. সাধারণ নাম: গমের বীজ, বৈজ্ঞানিক নাম: Triticum aestivum

বৈশিষ্ট্য: রং হালকা বাদামী।

• মাঝখানে একটি অনুদৈর্ঘ্য খাঁজ থাকে।

• ছোট শস্যগুলো গোলাকার এবং দীর্ঘতর আকৃতির হয়।

৯. সাধারণ নাম: গমের তুষ, বৈজ্ঞানিক নাম: Triticum aestivum

বৈশিষ্ট্য: রং হালকা বাদামী।

• গমের তুষ/ভুসি থাকে।

• গমের কণিকা উপস্থিত।

১০. সাধারণ নাম: রাইস পলিশ, বৈজ্ঞানিক নাম: Oryza Sativa

বৈশিষ্ট্য: রং গাঢ় বাদামী।

• কণা উপস্থিত।

• চালের অনেকটা পাউডারের মতো গড়ণ।

• চালের সুগন্ধ থাকে।

১১. সাধারণ নাম: সয়াবিন মিল, বৈজ্ঞানিক নাম: Glycine max

বৈশিষ্ট্য: রং ক্রিমি/মাখনের ন্যায়।

• চূর্ণিত সয়াবিন কণা উপস্থিত।

• সয়াবিন বীজের আবরন উপস্থিত।

• অসমতল আকৃতির হয়।

১২. সাধারণ নাম: খৈল, বৈজ্ঞানিক নাম: Brassica spp

বৈশিষ্ট্য: হলুদাভ কালো অথবা ক্রিমি কালো রঙ্গের হয়।

• সরিষার বীজ চূর্ণিত করে তৈরি করা হয়।

• ঝালোগন্ধ উপস্থিত।

১৩. সাধারণ নাম: তিল অয়েল কেক, বৈজ্ঞানিক নাম: Sesamum indicum

বৈশিষ্ট্য: গাঢ় কালো রঙের হয়।

• আবরণ উপস্থিত থাকে।

• তিলের ন্যায় গন্ধ পাওয়া যায়।

১৪. সাধারণ নাম: ডালের তুষ/পার্লস হাঙ্ক।

বৈশিষ্ট্য: বাদামী, ডালের বীজ দ্বারা আবৃত থাকে।

১৫. সাধারণ নাম: মিট এন্ড বোন মিল।

বৈশিষ্ট্য: গাঢ় বাদামী রঙের হয়।

• মাংস ও হাড়ের উপাদান পাওয়া যায়।

• মাংসল ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

১৬. সাধারণ নাম: ফিস মিল।

বৈশিষ্ট্য: গাঢ় বাদামী রঙের হয়।

• মাছের ন্যায় ঘ্রাণ পাওয়া যায়।

• মাছের কাঁটা পাওয়া যায়

• আঁশ ছড়ানো মাছ পাওয়া যায়।

১৭. সাধারণ নাম: সাধারণ লবণ।

বৈশিষ্ট্য: সাদা রঙের হয়।

• আকৃতি স্ফটিকের মতো/স্বচ্ছ

• স্বাদ নোনতা হয়

• অসমতল আকৃতির।

১৮. সাধারণ নাম: ইউরিয়া।

বৈশিষ্ট্য: সাদা রঙের হয়।

• কণিকাকার আকৃতির।

• সকল কণিকা বেশী অথবা কমভাবে একই ধরনের হয়।

• অ্যামোননিয়ার ন্যায় ঘ্রাণযুক্ত হয়।

মাংস উৎপাদনকারী গরুর সম্ভাবনা ও সমস্যা