গৃহপালিত পশুর শ্রেণিবিভাগ

গৃহপালিত পশুর শ্রেণিবিভাগঃ-

ব্যবহারের উপর ভিত্তি করে পোষ মানানো বা গৃহপালিত প্রাণি সমূহকে তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছে-

১. খাদ্যের জন্য ব্যবহৃত প্রাণিসমূহ, যেমনঃ গরু, মহিষ, ভেড়া, টার্কি ইত্যাদি।

২. ভার বহনের জন্য ব্যবহৃত প্রাণিসমূহ, যেমনঃ ঘোড়া, গাদা, উট ইত্যাদি।

৩. চিত্ত বিনোদন বা সঙ্গী হিসেবে ব্যবহৃত প্রাণিসমূহ, যেমনঃ কবুতর, কুকুর, বিড়াল ইত্যাদি।

গৃহপালিত পশুর শ্রেণিবিভাগ

প্রাণিসম্পদের অর্থনৈতিক গুরুত্বঃ-

মানবজীবনে পশুপাখির গুরুত্ব অপরিসীম। আদিযুগে মানুষ বনজঙ্গলে পশু শিকার করে এদের মাংস খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করত। পশুর চামড়া বস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে লজ্জা ও শীত নিবারণ করত। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গৃহপালিত প্রাণিসম্পদেও গুরুত্ব ব্যাপক ও বহুমুখী। গৃহপালিত পশুর অর্থনৈতিক গুরুত্ব বিভিন্ন ক্ষেত্রে নির্ধারণ করা যায়, যেমন-

১। খাদ্য উৎপাদনে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- পশুজাত খাদ্যে উদ্ভিদজাত খাদ্যের তুলনায় অধিকতর প্রোটিন, ভিটামিন ও খানিজ পদার্থ থাকে। তাই শরীর গঠন, বর্ষণ ও রোগ প্রতিরোধের জন্য একজন মানুষের প্রতিদিন ২৫০ মিলি দুধ, ১২০ গ্রাম মাংস এবং ১টি ডিম খাওয়া প্রয়োজন। দুধ ও মাংসের উৎস হিসেবে গৃহপালিত পশু-পাখি ব্যবহৃত হয় আর ডিমের উৎস হিসেবে মুরগি, হাঁস, কবুতর, কোয়েল ও টার্কি ব্যবহৃত হয়। দুধ একটি আদর্শ খাদ্য। দুধ দ্বারা প্রস্তুতকৃত দুগ্ধজাত পণ্য, মিষ্টি, দধি, লাচ্ছি, আইসক্রিম, ঘি, মাঘন ইত্যাদি প্রভৃতি খাদ্য হিসেবে এদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। প্রাণিজ আমিষের অপর একটি খাদ্য উপাদান হিসেবে মাংসও বেশ জনপ্রিয়। গরু, খাসি ও মুরগীর মাংস এদেশে অনেক জনপ্রিয়। দুধ ও মাংসের ন্যায় ডিমও একটি পুষ্টিকর খাদ্য। ডিমকে একটি পরিপূর্ণ পুষ্টির আধার বলা হয় কারণ এতে সকল পুষ্টি উপাদানই বিদ্যমান।

২। শক্তির উৎস হিসেবে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- মানব সভ্যতার শুরু থেকে অধ্যাবধি পশুসম্পদ কৃষি ক্ষেত্রে ও ভার বহনের কাজে শক্তির উৎস হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। হাল চাষ ও ফসল মাড়াইয়ের জন্য গরু, মহিষ ও খচ্চরের ব্যবহার পৃথিবীর বহুদেশেই বিদ্যমান। মরুভূমিতে ভার বহনের জন্য উট অথবা ঘোড়া ব্যবহার করা হয়ে থাকে। পাহাড়ী অঞ্চলে ভার বহনের জন্য ঘোড়া, গাদা অথবা ইয়াক ব্যবহার করা হয়। সমতল ভূমিতে ভার বহনের জন্য গরু, মহিষ ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়। কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনায় ধান, গম, কলাই ইত্যাদি ফসল মাড়াই কাজে পশুশক্তি ব্যবহার করা হয়। জমি থেকে ফসল আনার জন্য গরু বা মহিষের গাড়ি ব্যবহার করা হয়।

৩। জ্বালানি উৎস হিসেবে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- গরু বা মহিষের গোবর দিয়ে ঘুটে তৈরী করে তা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পশু পাখির মলমূত্র দিয়ে বায়োগ্যাস উৎপাদন করে রান্নার কাজে জ্বালানি হিসেবে ও বিদ্যুত হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

৪। পোল্ট্রির খাদ্য তৈরীতে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- পশু পাখির খাদ্য ও সার হিসেবে হাড়ের ব্যবহার বহুকাল থেকেই প্রচলিত। বর্তমানে দেশে ব্যাপকভাবে পোল্ট্রি ফার্ম ও ডেইরি ফার্ম গড়ে উঠায় ‘বোন মিল’ বা হাড়ের চাহিদা বেড়েছে। রক্ত একটি উন্নত মানের আমিষের উৎস। ব্লাড মিল মুরগি ও পশু খাদ্য হিসেবে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়।

৫। শিল্প হিসেবে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- বর্তমানে প্রাণিসম্পদ শিল্প হিসেবে স্বীকৃত। কারণ বর্তমানে দেশে বাণিজ্যিকভাবে বহু দুগ্ধখামার, পোল্ট্রি খামার গড়ে উঠেছে যেখানে বহু গরু, মহিষ, মুরগি পালন করা হয়। মিল্ক ভিটা দেশের বৃহত্তম দুগ্ধ প্রক্রিয়াকরণ ও দুগ্ধজাত সামগ্রী উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান। দেশে ব্যক্তি মালিকানাধীন বেশ সুদ্ধ প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। যেমন- টিউলিপ ডেইরি এন্ড ফুড প্রোডাক্ট লিঃ, আফতাপ ফ্রেম মিল্ক লিঃ ইত্যাদি। দেশে বর্তমানে বহু বৃহৎ, মাঝারি ও ক্ষুদ্রাকার পোল্ট্রি শিল্প গড়ে উঠেছে। যেমন- নারিশ পোল্ট্রি, কাজী ফার্ম লিঃ, সিপি ফার্ম প্রভৃতি বৃহৎ আকারের পোল্ট্রি ফার্ম। এসব ফার্মে গ্রান্ট প্যারেন্ট স্টক, প্যারেন্ট স্টক এবং বাণিজ্যিক খামার গড়ে উঠেছে।

৬। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে প্রাণিসম্পদেও গুরুত্বঃ- পৃথিবীর অনেক দেশ প্রাণিসম্পদ ও পশুজাত দ্রব্যাদি যথা-দুধ, মাংস ও ডিম রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করে। চামড়া ও চামড়াজাত দ্রব্য রপ্তানি বাংলাদেশের রপ্তানি আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। বাংলাদেশের রপ্তারি আয়ের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বর্তমানে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে। পশুর রক্ত জীবাণুমুক্তভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও বিপণনের ব্যবস্থার মাধ্যমে পশু-পাখির খাদ্য কারখানা গড়ে তোলা সম্ভব যা দেশের চাহিদা মিটিয়েও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের উৎস হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।

৭। আত্মকর্মসংস্থান ও দারিদ্রদ্র্য দূরীকরণে প্রাণিসম্পদের গুরুত্বঃ- নিজ উদ্যোগে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে কর্মে নিয়োজিত হওয়াকে আত্মকর্মসংস্থান বলে। আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে সহজেই সাবলম্বী হওয়া যায় এবং দারিদ্র্য দূর করা যায়। বাংলাদেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়ছে কর্মসংস্থানের চাহিদা কিন্তু দেশে জনসংখ্যার তুলনায় কর্মসংস্থান কম হওয়ায় বাড়ছে বেকারত্ব। এই বেকারত্বকে একমাত্র আত্মকর্মসংস্থানের মাধ্যমে জয় করা যায়। উদাহারণস্বরূপ- কম পুঁজিতে কম পরিশ্রমে ছাগল, ভেড়া ইত্যাদি লালন পালন করা যায়। আবার গ্রামের মহিলারা বাড়িতে হাঁস-মুরগি পালন করে স্বাবলম্বী হতে পারে।

গৃহপালিত প্রাণির সাধারণ বৈশিষ্ট্য ও শারীরতাত্ত্বীক অবস্থাঃ-

প্রাণিসম্পদ বলতে গৃহপালিত পশুদের বোঝায় যেগুলো মাংস, দুধ, ডিম, উল এবং অন্যান্য পণ্যসহ বিভিন্ন উদ্দেশ্যে লালন-পালন করা হয়। গবাদি পশুর সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং শারীরবৃত্তীয় অবস্থা প্রজাতি এবং বংশের উপর নির্ভর করে পরিবর্তিত হয়, তবে কিছু সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং শারীরবৃত্তীয় অবস্থা আলোচনা করা হলো-

১. পরিপাকতন্ত্রঃ গবাদি পশুর বিশেষ পরিপাক তন্ত্র রয়েছে যা তাদের খাদ্য ভেঙ্গে ফেলতে এবং উদ্ভিদের উপাদান থেকে পুষ্টি আহরণ করতে সাহায্য করে। গরু বা ভেড়ার মতো রুমিন্যান্টদের চার প্রকোষ্ঠের পাকস্থলী থাকে যা তাদের শক্ত উদ্ভিদের ফাইবারকে গাঁজন এবং হজম করতে সক্ষম করে।

২. একাধিক প্রজাতি: গবাদি পশু, ভেড়া, ছাগল, শুকর, হাঁস, ঘোড়া ইত্যাদির আরো বিভিন্ন প্রজাতি প্রাণিসম্পদ এর অন্তর্ভুক্ত। প্রতিটি প্রজাতির নিজস্ব বৈশিষ্ট্য এবং উদ্দেশ্য রয়েছে।

৩. তৃণভোজীঃ অধিকাংশ গবাদি পশুই তৃণভোজী, অর্থাৎ তারা প্রাথমিকভাবে উদ্ভিদ-ভিত্তিক খাদ্য গ্রহণ করে। তাদের পাচনতন্ত্র কার্যকরভাবে উদ্ভিদ উপাদান প্রক্রিয়াকরণ এবং পুষ্টি আহরণের জন্য অভিযোজিত হয়েছে।

৪. আচরণঃ গবাদি পশুর পাল বা পালের মধ্যে তাদের সামাজিক আচরণ এবং শ্রেণিবিন্যাস রয়েছে। তারা চারণ, বাসা বাঁধা এবং গ্রুমিং এর মতো সহজাত আচরণও প্রদর্শন করে।

৫. রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা। সাধারণ রোগ এবং সংক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য গবাদি পশুর একটি শক্তিশালী প্রতিরোধ ব্যবস্থা থাকে। ভ্যাকসিনেশন প্রোগ্রাম, সঠিক পুষ্টি এবং স্বাস্থ্যবিধি সহ ভাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা অনুশীলন, পশুদের সামগ্রিক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।

৬ . প্রজননঃ পশু যৌন প্রজনন করে এবং একটি গর্ভকালীন সময় থাকে যা প্রজাতিভেদে পরিবর্তিত হয়।পশুপালের প্রজনন দক্ষতা পশুপাল এবং মেষপাল রক্ষণাবেক্ষণ ও উন্নতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ।

৭. বৃদ্ধির হারঃ প্রাণিসম্পদ জাত ও প্রজাতি এবং পরিবেশগত কারণ তথা- পুষ্টি এবং রোগের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন হারে বৃদ্ধি পায়। এ বৃদ্ধির হার পশু বাজারজাত করার সময় মাংস বা অন্যান্য পণ্যের গুণমানকে প্রভাবিত করে।

৮. স্বাস্থ্যঃ গবাদি পশুদের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য পর্যাপ্ত পুষ্টি, বিশুদ্ধ পানি এবং আশ্রয়ের প্রয়োজন। তারা বিভিন্ন রোগ এবং পরজীবীর জন্যও সংবেদনশীল, যা তাদের বৃদ্ধি এবং উৎপাদনশীলতাকে প্রভাবিত করতে পারে।

৯. পরিবেশগত অভিযোজনযোগ্যতাঃ জাত ও প্রজাতির উপর নির্ভর করে বিভিন্ন জলবায়ু এবং পরিবেশের সাথে প্রাণিসম্পদের খাপ খাইয়ে নেওয়ার ক্ষমতা রয়েছে। কিছু প্রজাতি ঠান্ডা বা গরম জলবায়ুর জন্য বেশি উপযোগী, অন্যরা শুষ্ক বা আর্দ্র পরিবেশে ভালোভাবে মানিয়ে নেয়।

১০. উৎপাদনঃ মাংস, দুধ, ডিম, উল এবং অন্যান্য পণ্য সহ বিভিন্ন পণ্যের জন্য পশুপালন করা হয়। এই পণ্যগুলোর উৎপাদন জেনেটিক্স, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং অন্যান্য কারণগুলো দ্বারা প্রভাবিত হয়।

সামগ্রিকভাবে, প্রাণিসম্পদের সাধারণ বৈশিষ্ট্য এবং শারীরবৃত্তীয় অবস্থা জটিল এবং জেনেটিক্স, পুষ্টি, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশ সহ একাধিক কারণ দ্বারা প্রভাবিত।

বর্তমানে বাংলাদেশে গবাদি পশুর খাদ্যের অবস্থা